• ২০২৩ ডিসেম্বর ০৯, শনিবার, ১৪৩০ অগ্রহায়ণ ২৫
  • সর্বশেষ আপডেট : ২:২২ অপরাহ্ন
  • বেটা ভার্সন
Logo
  • ২০২৩ ডিসেম্বর ০৯, শনিবার, ১৪৩০ অগ্রহায়ণ ২৫

পারভেজ মোশাররফ: জানা অজানা নানা দিক

  • প্রকাশিত ১০:২৭ অপরাহ্ন রবিবার, ফেব্রুয়ারী ০৫, ২০২৩
পারভেজ মোশাররফ: জানা অজানা নানা দিক
সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ (৭৯) দীর্ঘ রোগভোগের পর রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। পাকিস্তানি টিভি চ্যানেল জিও নিউজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ সালে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন।

ফের ক্ষমতায় আসার পর নওয়াজ শরিফের সরকার মোশাররফকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করে এবং তাকে পাকিস্তানের একটি বিশেষ আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

এখানে তার জীবন এবং শাসনামলের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো-

শুরুর জীবন

মোশাররফ ১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ মোশাররফউদ্দিন (সরকারি চাকুরিজীবী ও কূটনীতিক) এবং মা বেগম জারিন মোশাররফ। তার আরও দুই ভাই রয়েছেন। তার ভাই ড. জাভেদ মোশাররফ একজন অর্থনীতিবিদ এবং ড. নাভেদ মোশাররফ একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাবসানের পর ভারত বিভক্তির পর, তার পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। সরকারি কর্মচারী বাবার চাকরির সুবাদে তিনি সাত বছর তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় কাটিয়েছেন।

১৯৫৬ সালে তার পরিবার করাচিতে বসবাস শুরু করেন; যেখানে মোশাররফ রোমান ক্যাথলিক এবং অন্যান্য খ্রিস্টান স্কুলে পড়াশোনা করেন। তিনি লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব ডিফেন্স স্টাডিজেও পড়াশোনা করেছেন।

তিনি করাচি থেকে ১৯৬৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর সেহবা মোশাররফকে বিয়ে করেন। তার ছেলের নাম বিলাল মোশাররফ এবং মেয়ের নাম আয়লা মোশাররফ।

মোশাররফ ১৮ বছর বয়সে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন এবং ভারতের সঙ্গে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ১৯৭১ সালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানের এলিট স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপের (এসএসজি) একটি কমান্ডো ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।

'কারগিল রূপরেখা'র মাধ্যমে আলোচিত হয়ে ওঠেন

পাকিস্তানের স্পেশাল সার্ভিস কমান্ডো গ্রুপে সাত বছর দায়িত্ব পালন করেছেন মোশাররফ। তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের অধীনে ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে সেনাপ্রধানের পদে উন্নীত হন।

তিনি ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে কাশ্মীরে পাক সেনাদের অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। পরবর্তীতে যার ফলে কার্গিল যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়।

প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষক এবং 'কারগিল: দ্য হাইটস অব ব্রেভারি'-বই এর লেখক আজাদ সিং রাঠোর ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ লিখেছেন, ‘মোশাররফ একটি পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন। ওই পরিকল্পনায় কাশ্মীরে তাদের পাক সেনাবাহিনীকে ঢোকানোর জন্য আরও বেশি ‘মুজাহিদিন’-দের ভারতে ঢোকানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন।’

এছাড়া, পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে উঠলে ভারত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাবে না- মোশাররফের এই ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সামান্য লাভ এবং উল্লেখযোগ্য ক্ষতির পাশাপাশি; আন্তর্জাতিক চাপের কারণে নওয়াজ শরীফ পরবর্তীতে সৈন্যদের পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এই পদক্ষেপের ফলে সামরিক বাহিনী নওয়াজ শরীফের ওপর নাখোশ হয়।

১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর মোশাররফ দেশের বাইরে থাকাবস্থায় নওয়াজ শরীফ তাকে বরখাস্ত করেন এবং মোশাররফকে বহনকারী বিমানটিকে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণে বাধা দেয়।

১৯৯৯ সালেই একটি রক্তপাতহীন অথচ নাটকীয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজ শরীফের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন মোশাররফ।

২০০১ সালের জুনে মোশাররফ একটি বিতর্কিত গণভোটে জয়লাভ করেন এবং তার শাসনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়।

মধ্যমপন্থা অনুসরণকারী ইমেজ

ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায়, ‘সিগারেট ও বিদেশি হুইস্কির প্রতি মোশাররফের ঝোঁক ছিল। মুসলমানদের প্রতি তার 'আলোকিত মধ্যপন্থা'র আলোকে জীবনধারা পরিচালনার আহ্বান; পশ্চিমে তার আবেদন বাড়িয়ে তোলে। বিশেষ করে নিউইয়র্কে ৯/১১ হামলার পরে।’ এ হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’- মতবাদের সমর্থক ছিলেন তিনি।

তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আমেরিকা একটি আহত ভালুকের মতো সহিংসভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিশ্চিত ছিল।’

মোশাররফ বলেন, ‘যদি অপরাধী আল-কায়েদা হয়ে ওঠে, তবে সেই আহত ভালুকটি সরাসরি আমাদের দিকে ধাবিত হবে।’

তিনি আরও বলেন, ২০১১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল তাকে বলেছিলেন যে পাকিস্তানকে হয় ‘আমাদের সঙ্গে থাকতে হবে নতুবা আমাদের বিরুদ্ধে যেতে হবে’। অন্য একজন আমেরিকান কর্মকর্তা বোমা মেরে পাকিস্তানকে ‘প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে’ দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, যদি তারা দ্বিতীয়টি (আমেরিকার বিরুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত) বেছে নেয়।

নারীর অধিকার রক্ষায় আইনের মাধ্যমে এবং প্রথমবারের মতো বেসরকারি নিউজ চ্যানেল পরিচালনার অনুমতি দিয়ে মোশাররফ একজন মধ্যপন্থী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিতি পান। তার সময়ে পাকিস্তানে বিদেশি বিনিয়োগও বেড়েছিল।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহও দেখিয়েছেন তিনি।

২০০৪ সালে ইসলামাবাদে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) শীর্ষ সম্মেলনের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে মিলে এই দুই নেতা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছিলেন। যা ‘সংযুক্ত সংলাপ প্রক্রিয়া’র ভিত্তিতে তৈরি হয়েছিল, যার মধ্যে কাশ্মীরসহ আটটি বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল।

তার শাসনামলে কিছু বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে সেনাবাহিনীর ওপর এক হামলায় ১০২ জন নিহত হয়। জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও বিরোধিতা আরও বেড়ে যায় এবং একের পর এক আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে তার সুনাম নষ্ট হয়।

উচ্চপদস্থ বেসামরিক এবং সামরিক উভয় পদে তার একযোগে অধিষ্ঠিত হওয়ায়, দেশটির অভিজাত মহলে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা শুরু হয়।

বিচার বিভাগ তার সরকারকে বেআইনি ঘোষণা করবে এই ভয়ে, তীব্র জনরোষের মধ্যেও মোশাররফ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করেন।

এছাড়াও, ২০০৭ সালের অক্টোবরে করাচিতে বেনজির ভুট্টোর মোটর সমাবেশে আত্মঘাতী বোমা হামলায় কমপক্ষে ১৩৯ জন নিহত হয়েছিল। দেশটির সাবেক এই নারী প্রধানমন্ত্রী আট বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে সেদিনই করাচিতে ফিরছিলেন। এর দুই মাস পর রাওয়ালপিন্ডিতে বন্দুক ও বোমা হামলায় বেনজির নিহত হন।

এছাড়াও তার শাসনকালে অন্যান্য অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। যেমন-জঙ্গিরা ২০০৩ সালে মোশাররফকে বোমা মেরে দু’বার হত্যার চেষ্টা করেছিল। প্রথমবার জঙ্গিরা একটি সেতুতে বোমা স্থাপন করে এবং তারপরে গাড়ি বোমা হামলা করে। দ্বিতীয় আক্রমণে মোশাররফের গাড়িটি মাটি স্পর্শ করার আগেই বিস্ফোরণ ঘটে গাড়িটি ছিটকে পড়ে।

এই হামলার স্মৃতিচারণ করে মোশাররফ লিখেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি।’

অবশেষে, ২০০৮ সালের আগস্টে ক্ষমতাসীন জোট তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু করতে একমত হওয়ার পর, প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মোশাররফ পদত্যাগ করেন।

টেলিভিশনে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি জাতি ও জনগণ আমার ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।

ফৌজদারি অভিযোগ এবং পরবর্তী জীবন

বেশিরভাগ সময় লন্ডন ও দুবাইতে বসবাসকারী মোশাররফ একবার ২০১২ সালে রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সমর্থনের অভাবে তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তাকে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দি করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বরখাস্ত করার প্রচেষ্টার কারণে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।

২০১৬ সালে চিকিৎসার জন্য তাকে জামিনে দুবাই যাওয়ার অনুমতি দেয় পাকিস্তান। এরপর থেকেই তিনি দুবাইতে ছিলেন, এমনকি তিনি তার বিরুদ্ধে করা মামলার বিরুদ্ধে আপিলও করেছিলেন।

তবে, ২০১৯ সালে দেশটির একটি বিশেষ আদালত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মোশাররফের অনুপস্থিতিতে তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং মৃত্যুদণ্ড দেন।

কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে লাহোর হাইকোর্ট মোশাররফের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতের জারি করা সাজাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেন।

২০১৮ সালের শেষের দিকে জানা যায় যে মোশাররফ অ্যামাইলয়েডোসিস নামের এক বিরল রোগে আক্রান্ত। যার কারণে দ্রুত তার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।

সূত্র: এপি, রয়টার্স ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও উইকিবায়ো.ইন


সর্বশেষ